বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

নিশ্চুপ বিদায়



নিশ্চুপ বিদায়

খানিকটা বাংলা খানিকটা বিহারী আর খানিকটা হিন্দি ভাষা মেশানো চিৎকারটা শুনতে পাচ্ছি মোড়ের শেষমাথার বাড়িটার




সামনে থেকে। চিৎকারের চেয়ে আর্তনাদ বলাই ভাল।




কৌতুহলে বাড়িটার কাছাকাছি যেতেই দেখলাম প্রচুর লোক ভীড় জমিয়েছে সেখানে যেন সার্কাসে বানরের খেলা দেখানো




হচ্ছে।




পাগলিটা চেঁচাচ্ছে।




মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে পাগলিটা।




শব্দটা দোতলা অব্দি যাচ্ছে।




জানালার সামনে বসা মিসেস ফাতেমাই পাগলির লক্ষ্য। বাড়ীর মালকিন। রবিনের মা।




বিরক্তমুখে একবার রবিনের ঘরের দিকে তাকাচ্ছেন, একবার পাগলির দিকে। ঝামেলা যতসব!




উসকো-খুসকো চুল, একহারা চেহারা, উজ্জ্বল দুটো চোখ, রোদেপোড়া চামড়ার তলায় আসল রঙ বোঝায় এককালে




সুন্দরীই ছিল, গায়ে শতচ্ছিন্ন শাড়ি, ডানহাতে বহু পুরাতন বালা, চিৎকারের ভাষা প্রকাশ করে সে বিহারী।




পিতৃপ্রদত্ত নাম ললিতা, মাথা অনেক আগে থেকে খারাপ, এলাকায় আছে বহুদিন, একা একাই ঘুরে বেড়ায় সারাদিন।




কখনো এ বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ে তো কোনদিন ও বাড়িতে গিয়ে খাবার খায়।




ভালবেসে বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, অথর্ব অনাত্মীয় দয়ার যোগ্য, ভালবাসা না।







ললিতারও একটা সংসার ছিল, বিহারী বস্তিতে ছোট্ট ঘরে অভাবে ভরা সুখের সংসার। হঠাত একদিন চোখের সামনে




সবাইকে আগুনে পুড়তে দেখল, শরীরের উপর একটা বিশালদেহী রোমশ শরীর উঠে আসতে দেখলো, মাবাপ তুলে




গালাগাল শুনল। ললিতার আর কিছু মনে নাই। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা তখন থেকে শুরু। ললিতা নামটাও হয়ত হারিয়ে




যেত,




যদি না হঠাত এক আত্মীয় তাঁকে আবিষ্কার করে, কিছু খাবারের বদলে মধ্যরাতে তাঁকে নিয়ে নির্জনে চলে যেত।







গতকাল থেকে কোনমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছে।




দারোয়ানের পা বেশ শক্ত, ভয়ানক একেকটা লাত্থি। পথের ভিখারীর এপার্টমেন্ট বাসার বেসমেন্টে ঘুমানোর স্বাদ জন্মের




মত মিটিয়ে দিয়েছে সে পিটিয়ে। লাঠির বাড়ি পড়েছে ডানপায়ের হাড্ডিতে, চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে, ললিতা কাঁদছে, চিৎকার




করে কাঁদছে। কিন্তু এই কান্না কে বুঝতে যাচ্ছে!




মিসেস ফাতেমার প্রেশার বাড়ছে। সহ্য অনেক করেছেন। আমজাদ সাহেব যদি ব্যাপারটা না দেখে, তিনি ঘর ছাড়বেন।




সন্ধ্যাবেলা, তার ৮ বছরের ছেলেটাকে থাপ্পড় মেরেছে পাগলি। সাহস দেখো কত! এলাকার লোকজন এলোপাথাড়ি মারতে




থাকে পাগলিকে। শিল্পপতির ছেলের গায়ে হাত দেয়া সহজ কথা না।




ছেলেটা আগে তাঁর গায়ে লাঠি দিয়ে মারছিল, কিন্তু পাগলের কথা কে শুনতে যায়। মার থামলো না।




মিসেস ফাতেমা উপর থেকে মারতে মানা করছেন, অসস্তি বাড়ছে তাঁর। ছেলেটা অনেক দুরন্ত হয়েছে, নতুন কিনে আনা




হকিস্টিক নিয়ে কেন পাগলির উপরই ওর ডেমো দিতে হবে!




ছেলেকে শাসন করতে গিয়ে উত্তর শুনে থমকে গেলেন, ‘যেদিন ওকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা মারলে, সেদিন তো বললে, মানুষ




না, ওতো পাগল! আমিও তো মানুষকে মারিনি, পাগলকে মেরেছি!’




দাঁত কিড়মিড় করছেন মিসেস ফাতেমা, তাঁর কাছে রাগ লাগে এই পাকাপাকা কথা, বাঙাল মায়েদের মত মধুর লাগেনা।




পেটেধরা হলে হয়ত লাগত।




৮ বছর আগের কথা।




মিসেস ফাতেমা আর আমজাদ সাহেব ছিলেন নিঃসন্তান দম্পতি, শিল্পপতি আমজাদ সাহেবের সম্পত্তির উত্তরাধিকারীর




অভাব তাকে দুশ্চিন্তায় পাগল করে ফেলেছিল।




আবার সন্তান না থাকার হাহাকার ফাতেমাকে প্রায় মানসিক রোগীর মত বানিয়ে দিচ্ছিল। পরিচিতদের আমজাদ সাহেব




নিজের সমস্যা বলেই চালিয়ে দিয়েছেন, ফাতেমাকে ভালবাসতেন। পরিবার থেকে দ্বিতীয় বিয়ের চাপের ঝামেলা নিতে




চাননা তিনি।




এক রাতের বেলা, বেশ দেরি করেই বাড়ি ফেরেন আমজাদ সাহেব।




ব্যক্তিগত সহকারীর কোলে কি যেন একটা।




একটা ফুটফুটে বাচ্চা!







কোন হারামজাদা কুকাজ করে দিয়েছিল, এলাকার পাগলিটা কনসিভ করে ফেলেছে, এখন এ বাচ্চাতো কুকুর বেড়ালে




খেতে দেয়া যায় না!




সমাজের অধঃপতনের উপর আধাঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে দিলেন,




তারপর স্ত্রীকে বোঝান যে, পাগলির কাছে থাকলে বাচ্চাটার অন্ধকার ভবিষ্যৎ হবে, আবার তাদের সন্তান দরকার, তাই




বাচ্চাটাকে দত্তক নিয়ে নেওয়াই ভাল। স্বামীভক্ত ফাতেমা অম্লানবদনে বাচ্চাটাকে কোলে নেন।




তারও তো মাতৃত্বের স্বাদ পেতে ইচ্ছে করে, যদিও তিনি বুঝেছেন, বাচ্চার বাবা আমজাদ সাহেবই।







রাত অনেক হয়ে গেছে। ললিতা মার খেয়ে নেতিয়ে পড়ে আছে। খাবার চেয়ে লাত্থি খেয়েছে আরেক চোট। রক্তে ভেসে




যাচ্ছে কাপড়। পাগলের ডাক্তার লাগেনা, নোংরা পাগলের কাছে কে আসবে?




আসে হয়তো কেউ কেউ, কামনা মেটাতে, হাতের ঝাল মেটাতে।







ডাস্টবিনের সামনে পড়ে থাকা পাগলির সামনে গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ালো রবিন, মা-বাবা ঘুমুতে যেতে দেরি না করলে




আরো আগেই লুকিয়ে বের হতে পারত। তার হাতে কিছু খাবার আর গামছা, তুলা,পানি, স্যাভলন। অনেক ব্লিডিং হতে




দেখছিল। আজ তার জন্য পাগলি বেচারি মার খেয়েছে। খারাপ লাগছে তার, চোখে পানি, কেন মানুষ এদের সাথে এমন




করে?







ললিতা চোখ বন্ধ করে মৃত্যুর অপেক্ষা করছিল, হঠাৎ কোমল হাতের স্পর্শ তাকে জাগিয়ে তুলল। হ্যা এসেছে, ছেলেটা




এসেছে! এই ছেলেটাই সন্ধ্যায় কি মার মেরেছে, মমতার জোর সব ভুলিয়ে দিচ্ছে।




এত আপন লাগে কেন ছেলেটাকে? যেন নিজের রক্তে গড়া!




এই ছেলেটার চোখে পানি! কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করল ছেলেটাকে।







অনেক আনন্দ হতে লাগল মনে, চোখে স্নেহ নিয়ে ছেলেটাকে চলে যেতে দেখল। জীবনে তার যা পাওয়ার হয়ে গেছে।




মাথাটা ফাকা লাগছে ললিতার, চোখ বুঝল শান্তি নিয়ে।




আর কাউকে কোনদিন জ্বালাতে আসবে না সে। নীরবেই বিদায় নিচ্ছে।







সে জানে তার জন্য আর কারো চোখের পানি পড়বে না, কষ্টে বুক ফাটবে না। পৃথিবী হতে অনুচ্ছক এক প্রাণ হারিয়ে




যাচ্ছে টুপ করে, নিঃশব্দে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নিশ্চুপ বিদায়

নিশ্চুপ বিদায় খানিকটা বাংলা খানিকটা বিহারী আর খানিকটা হিন্দি ভাষা মেশানো চিৎকারটা শুনতে পাচ্ছি মোড়ের শেষমাথার বাড়িটার সামনে থেকে। চিৎকারের ...