রবিবার, ১৯ জুলাই, ২০২০

আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে




রাত দেড়টা।



মিসির আলী সাহেবের কাছে একবার যাওয়া দরকার, বেশকিছুদিন ধরেই যাওয়া হচ্ছেনা।

তবে আজ মনে হচ্ছে যাওয়া যায়।



আসলে ভদ্রলোক বাসা থেকেই বের হন না, কেস নেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন বেশ কবছর

হলো।

এখন বাড়িতে বসে শুধু পড়াশোনা নিয়ে মত্ত থাকেন, আর আছে চিরসঙ্গী অসুস্থতা।

তবে বাবার ব্যবসা সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত শুভ্র সব ছেড়েছুড়ে আজকাল মিসির আলীর সঙ্গে থাকছে।

ছেলেটা মিসির আলীকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে, চিরতরে অন্ধ হয়ে গেছে ৬ বছর আগে, তবু

পড়াশোনা ছাড়েনি, এক্সপ্রেসো কফি নিয়ে মোহনীয় হাসিটা নিয়ে আজও তাঁকে রাতের

আকাশ দেখতে দেখা যায়। চোখের দেখাই যে সবকিছু নয়, মনের দেখাই যে অনেক

কিছু।

সরল সুন্দর শুভ্রের শুভ্রতা ধুয়েমুছে যাচ্ছিল ব্যবসায়িক জটিলতা, সাংসারিক জটিলতার

চাপে। তবে এখন মিসির আলী মানুষটার জ্ঞানের সঙ্গ পেয়ে শুভ্রর মনে হচ্ছে সে দুনিয়ার

শ্রেষ্ঠ মানুষটার সাথে বসবাস করছে।

“খালা আছো? শূন্য বাড়িটার দিকে এগিয়ে দরজাটায় আনমনে ধাক্কা দিলাম। জানি কেউ

খুলবে না। ঢাকার সব বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করে বাদল আর মাজেদা খালাকে নিয়ে খালু

অনেকদিন আগেই পাড়ি জমিয়েছেন আমেরিকা।

সেখানেই করেছেন বাড়ি, ছেলেকে ব্যবসায় নামিয়ে দিয়ে হঠাৎ একদিন চলে গেলেন,

অতিরিক্ত মদ্যপানে স্ট্রোক অস্বাভাবিক কিছু না। বাদল বিয়ে করেছে, ফুটফুটে দুটো

বাচ্চাও আছে। বাদলের কি আমাকে মনে পড়ে?





হয়তো হঠাৎ কোন বিষন্ন বিকেলে একা একা বসে পাগলামি গুলো মনে করে ফিক করে

হেসে দেয়।





বাসায় ভালো রান্না হলে মাজেদা খালা তাঁর হিমুর পথ চেয়ে বসে থাকে,

শতবার মুখ না দেখার প্রতিজ্ঞা করলেও এতিম ছেলেটাকে যে নিজের ছেলে থেকে কম

ভালোবাসতেন না তিনি, আমেরিকায় বসেও একের পর এক পাত্রী দেখে বেড়ান তিনি,

হিমুর তো কোন ঠিক নেই, হয়তো একদিন আমেরিকাই চলে আসলো, এবার ধরেবেধে

বিয়ে দেবেন তিনি। তবে তিনি জানেন না, হিমুরা যে আর কোনদিন ফিরবেনা।





-এই যে হ্যালো, দাড়ান এখানে। এত রাতে বেলা এমনভাবে কোথায় যাচ্ছেন?




– সামনেই যাব, বন্ধুর বাড়ি




– হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে বন্ধুর বাড়ি? রাত দেড়টার সময়? এই মধ্যবয়সে হিমুগিরির সখ

জেগেছে নাকি? ডলা দিয়ে এই পাগলামি ছুটায়া দেব একদম




– স্যার আমিই তো হিমু, আমার হিমুগিরি কিভাবে ছুটাবেন?




– ফাজলামো করেন আমার সাথে? চিনেন আমাকে? শহরের সেরা ক্রিমিনাল আমার নামে

ভয়ে বাথরুমে দৌড়াবে, প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল আছে আমার।




আমার সাথে ফাজলামো করলে কি হয় বুঝতে পারছেন না!

মুচকি হাসলাম মনে মনে, ব্যাজ দেখে চিনে নিয়েছি ধানমন্ডি থানার ওসি আমার সামনে

দাঁড়িয়ে। বেশি বয়স হবে না, পঁয়ত্রিশের মত হবে। বেশ লম্বা, সুপুরুষ উজ্জ্বল শ্যামলা

চেহারা, স্বাস্থ্যবান মানুষ, অমন গোমড়ামুখো না হলে কিছুতেই পুলিশে মানানসই লাগত

না।

একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

এর সাথে বেশি কিছু না বলাই ভালো, আজকালকার পুলিশরা আগের মত

ঢালতলোয়ারবিহীন না, এদের কথার আগে গুলি ছুটে। বলা যায় না, কখন ক্রসফায়ার

করে দেয়।





– স্যার, হলুদ পাঞ্জাবিতে কোন নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে নাকি?




– দেখুন আমার তর্কের মুড নাই, বেশি ফাজলেমো করলে ডাইরেক্ট গাড়িতে উঠায়া নিব।




– স্যার কি একা? পুলিশের বড় সাহেবকে একা একা মানায় না তো। যেকোন সময় বিপদ

ধাওয়া করতে পারে।




– আপনারে আমার চিন্তা করতে হবে না, ওয়ার্নিং দিলাম, রাতবিরাতে যেন না দেখি।

– আচ্ছা স্যার, এখন থেকে ইনভিন্সিবল হয়ে যাতায়াত করব। স্যার বেনসন হবে একটা?

উনার অগ্নিদৃষ্টি দেখে আর ঘাঁটালাম না। এগিয়ে গেলাম।




কিছুদূর যেতেই পেছনে চিৎকার

শুনে ঘুরে দেখি, কোন বড় লোকের বাড়ি থেকে পালানো বিদেশি কুকুরের তাড়া খেয়ে

ওসি সাহেব পাগলের মত দৌড়াচ্ছেন, সমস্ত পৌরুষ, গোল্ড মেডেলের হিসেব বোধহয়

ওই কুকুরই নিয়ে ছাড়বে। আর দেখার সময় নেই। আমি হাটা দিলাম।





মিসির আলী সাহেব ঘুমাচ্ছেন। শুভ্র রান্না করছে। বলল,

চাচা এত দেরী হলো যে!

আমাকে চমকানো বেশ কঠিন, তবে শুভ্র আমাকে মুহূর্তে মুহূর্তে চমকায়,

খবর দিইনি। আর এই ছেলে আমার জন্য ভাত বসিয়ে রেখেছে।





– চাচা আমার মনে হচ্ছিল আজ তুমি আসবে। এবং বরাবরের মতই থাকবে না খাওয়া।

তাই রান্নাটা করে ফেললাম। আমি স্যারকে ডাক দিই। তুমিও হাতমুখ ধুয়ে এসো,

একসাথে খাব।





১৯ জুলাই মধ্যরাত।

খোলা আকাশের নিচে একসাথে অনেকগুলো মানুষ এক নন্দন কাননে বসে আছে।

উদ্দেশ্য জোৎস্না দেখার।





গুন্ডা গুন্ডা চেহারার এক লোক, সানগ্লাস পড়া, সমানে দুষ্টুমি করে চলেছে নিলু ভাবীর

সাথে, রফিকের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল বটে,

কিন্তু ওই ব্যাটা খালি বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকায় বাকের খুব রাগ করে ওর উপর।

অবশ্য তাঁরও যে মুনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে

হচ্ছে না তা না, কিন্তু মুনা পাথুরে মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে যেন কোথাও কেউ

নেই।

নীলু ভাবী এই একটা দিন বেশ খুশি থাকেন, টুনিকে এমনভাবে গলা জড়িয়ে রেখেছেন,

টুনির মনে হচ্ছে দম আটকে যাবে, তবু বড় ভাল লাগছে।




মিসির আলী লোকটাকে বেশ ভালো লাগে শফিকের, লোকটা আলতুফালতু কথা বলে না, এর সাথে

কথা বলতে ভালই লাগে।

মিসির আলীকে পেয়েই আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়েছে শফিক।

পাখিটার গলা টিপে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে শারমিনের, সেই কখন থেকে চিৎকার করছে,

‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’, রফিকের মনটা খারাপ হবে বলে পারছে না।




বাদলকে এই একটা দিনের জন্য ধরে এনেছিল হিমু, বাদল এসেই জুটে পড়েছে হিমুর

সাথে।

দিনগুলির কথা ভোলেনি বাদল, বাদল হারিয়ে যেতে চায় সে দিনগুলিতে, তবে

বাস্তবতাকে অস্বীকার করে নয়।




ওদিকে মাজেদা খালা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন এক ফিরিঙ্গি মেয়ের ছবি,

হিমুকে দেখানোর জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

লক্ষণ খারাপ দেখে বাদলকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে পড়েছে হিমু।

আর শুভ্র মুগ্ধ হয়ে শুনছে সবাইকে।




তাঁরা তিনজন এই মধ্যরাত্রির বনভোজনকে ঘিরে ব্যবসার বুদ্ধি খুঁজছে, মামার মাথায় যতই আইডিয়া

গজাচ্ছে, ভাগ্নেরা যথারীতি ভজকট পাকাচ্ছে। ওদের ধোলাই দিতে খুঁজছে সেই পুলিশ অফিসার।




আরেকটি দিকে দুই আনিস একসাথে বসে আছে।

এক আনিস এই অপার্থিব পরিবেশে

অসাধারণ সব জাদু দেখাতে চাইছে,

আর একজন লিখে ফেলতে চাইছে সবকিছু,

বাচ্চাগুলোর জ্বালায় পারছেনা, মাথায় আসছে না কিছু।

কোথায় যে গেছে এরা কে জানে!

জোৎস্নার অপেক্ষায় আছে দুজনেই।





হালকা হালকা বৃষ্টিও পড়ছে।

আজকের জোৎস্নাটাকে করে দিচ্ছে আলাদা।

এই জোৎস্নায় নিশ্চিতভাবে মিশে আছে এক জোৎস্নাপ্রেমিক,

তারিয়ে তারিয়ে হয়তো উপভোগ করছেন এই মুহূর্তটা।




নুহাশ পল্লীর বড় গাছটার নিচে, বাদল আর আনিসের ছেলেমেয়েদের দেখা গেল।

এক মাঝবয়সী ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোকের পামিং দেখছে।




মাথাভর্তি চুলগুলোর ফাঁকেফাঁকে ঈষৎ পাকা চুল দেখা যাচ্ছে, চোখে সেই চশমা, মুখে

এক চিলতে চিরচেনা হাসি, গায়ে প্রিয় হাফশার্ট আর প্যান্ট।

আনিসের ছেলেটা নিষাদকে মনে করিয়ে দিচ্ছে বড়ো!

আর থাকা যাবে না!

মায়া বাড়ানো যাবেনা।





ভোর হয়ে আসছে, জাদুকর বিদায় নিচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে।

তাঁর সাথে বৃষ্টির যোগাযোগটা অনন্য।

জাদুকর ছাড়া বাকিরা ছন্নছাড়া।

হয়তো তাঁরা তাই ফিরবেও না আর কোনদিন।







লেখাটি এখানে প্রথম প্রকাশিত হয় - হিমুর দিনরাত্রী



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নিশ্চুপ বিদায়

নিশ্চুপ বিদায় খানিকটা বাংলা খানিকটা বিহারী আর খানিকটা হিন্দি ভাষা মেশানো চিৎকারটা শুনতে পাচ্ছি মোড়ের শেষমাথার বাড়িটার সামনে থেকে। চিৎকারের ...